আমি ও সনমান্দী হাসান খান উচ্চ বিদ্যালয়
Created by :
saidulhaque, sonmandi
article
Programming, Software and application
923
2022-10-22 15:52:55
“গুপী গাইন বাঘা বাইন”, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী রচিত একটি রূপকথার গল্প। গল্পের দুই নায়ক গুপী ও বাঘা সঙ্গীতের অনুরক্ত, অথচ সাংগীতিক প্রতিভাহীন এবং যেই তারা সংগিত করতে যাইতো গ্রামের সবাই খুবই বিরক্ত হত। এই কারণে গুপীর গ্রাম আমলকী ও বাঘার গ্রাম হরতুকী থেকে তারা বিতাড়িত হয় এবং পরে তারা গ্রাম থেকে দূরে কোন জংগলে এক ভূতের রাজার দেখা পায় এবং সেই ভূতের দেওয়া বর পেয়ে সঙ্গীত প্রতিভা দিয়েই সকলকে জয় করেন।
১৯৯৩ সাল। সনমান্দী হাসান খান উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তির পর মান উন্নয়ন পরীক্ষায় আমাকে প্রথম স্থান অর্জনে এই “গুপী গাইন বাঘা বাইন” গল্পের বইটি পুরুস্কার হিসাবে দেওয়া হয়েছিল। সনমান্দী হাসান খান উচ্চ বিদ্যালয় এবং এই বইটি আমার জীবনে বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল।
আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভালো ছাত্র ছিলাম সেটা বলতে পারবো না কারন পড়ালেখা আসলে কি, ততদিনে তা বুঝা হয়ে ওঠেনি। তবে আমাকে নিয়ে স্যারেরা অনেক প্রত্যাশা করেছিলো। পঞ্চম শ্রেনীতে পাশ করার পর প্রাইমারি স্কুলের স্যারেরা আমার বাড়ি এসে আমার বাবা মাকে অনুরোধ করেছিলো আমি পঞ্চম শ্রেনীতে আরেক বছর থাকতে। এক বছর বেশি থেকে বৃত্তি পরীক্ষা দিলে বৃত্তি পেতে পারি। কিন্তু আমার হাই স্কুলে পড়ার জন্য মন বেকুল ছিলো। আর তাই, সেই বছরই সনমান্দী হাসান খান উচ্চ বিদ্যালয় এ ভর্তি হয় এবং এক-দের মাস পরে মান উন্নয়ন পরীক্ষায় আমি প্রথম হই। আর তখন থেকেই পড়ালেখা একটু একটু করে আমার বুঝতে শুরু করি।
১৯৯৩ সালের আমাদের স্কুল থেকে মাহফুজুল ইসলাম হায়দার সেলিম ভাই মানবিক বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়ে স্টার মার্ক নিয়ে পাস করে। আর সেই স্টার মার্কই ছিলো আমাদের স্কুলের প্রথমবার কোন ছাত্রের স্টার মার্ক পাওয়া। সেলিম ভাই এখন বিসিএস ক্যাডার এবং বর্তমানে উনি ফেনির পরশুরাম সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ৯৩ সাল থেকেই আমি, সেলিম ভাইকে আমার একজন মেন্টর হিসাবে নিয়েছিলাম এবং মনে মনে আশা ছিলো এসএসসি তে উনার মত ভালো কিছু করার।
১৯৯৫ সাল। আমি সপ্তম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উঠি। সেই বছর আমাদের বিদ্যালয়ের আগের সমস্ত পরিক্ষার চেয়ে আমিই বেশি নম্বর পেয়ে উত্তির্ন হয়েছিলাম। এরজন্যেও একটি বই উপহার পেয়েছিলাম।
১৯৯৬ সাল। আমি নবম শ্রেণিতে উঠি। আমার ইচ্ছে, সাইন্স নিয়ে পড়া। আর এই জন্য, আমার টার্গেট ছিলো স্কুলে শ্রেণির পড়া শুরুর আগে গনিত ও ইংরেজি বইটির অনেকাংশ শেষ করে ফেলা। তাই আমার চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে এই দুটি বই নিয়ে লেখা পড়া শুরু করলাম। আর ডিসেম্বরের মধ্যেই পাটিগণিত প্রায় শেষ করে ফেলছিলাম, বীজগণিতেরও অনেকগুলো অধ্যায় শেষ করেছিলাম। কিন্তু জানুয়ারীতে শুনি মাধ্যমিক পরীক্ষার সব বই পরিবর্তন হয়ে নতুন বই হবে। চিন্তায় পরে গেলাম নতুন বই, নতুন সিলেবাস। আগের কোন পরিক্ষার নমুনা প্রশ্নপত্র থাকবে না। পরিক্ষার প্রশ্ন কেমন হবে ইত্যাদি। আবার নতুন বই বাজারে আসতেও দেরি হচ্ছে। মনে আছে মুল বই কেনার আগে গাইড বই কিনেছিলাম। বই নিয়ে ছিল এক চিন্তা আবার সনমান্দী হাসান খান উচ্চ বিদ্যালয়ে আমি একাই বিজ্ঞান বিভাগে ছাত্র। অনেক চিন্তা ভাবনা করে অন্য স্কুল সোনার বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানান্তর হওয়ার জন্য মনস্থির করি এবং সেখানে ক্লাস শুরু করি। তবে বেশিদিন আর ক্লাস করা হয়নি কারন সনমান্দী স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহ সবাই আমার বাড়িতে এসে মা-বাবাকে বিশেষ অনুরোধ করলো যে সাইদুল যেন সনমান্দী স্কুলে থেকেই এস.এস.সি পরিক্ষা দেয়। তারপর মা বাবা আমাকে বুঝিয়ে বলল, শিক্ষকদের মনে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। আর তাই আবার সনমান্দী স্কুলে চলে আসলাম।
নতুন বই পেলাম ১৯৯৬ সালের মার্চের দিকে। ক্লাস শুরু। বিজ্ঞান বিভাগে আমি আর বিএসসি বাবু স্যার। ভালোই চলছিল ওয়ান টু ওয়ান লেখাপড়া। বাবু স্যারের মনে মনে এত প্রেম ছিল তখন বুঝতে পারি নাই। নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেনিতে ওঠার সাথে সাথে স্যার তার প্রেমকে নিয়ে চলে গেল। স্কুলে কোন বিজ্ঞানের শিক্ষক নাই। আমি একা বিজ্ঞানের ছাত্র। বাসা থেকে আসে পাশে তেমন কোন বিজ্ঞানের শিক্ষকও ছিল না। কিন্তু আমি এক বিষয়ে একাধিক গাইড বই কিনে নিজে নিজে পড়তে থাকলাম। প্রি-টেস্ট এর আগ দিয়ে একজন বিজ্ঞানের শিক্ষক আসলো কিন্তু উনার থেকে আর তেমন কিছু শিখা হল না কারন ততদিনে পড়া শেষ। তখন পরিক্ষার পড়া চলছিলো।
প্রি-টেস্ট ও টেস্ট শেষ হল। আমাদের স্কুলে তখন ইংরেজি বিষয়েরও ভালো শিক্ষক ছিল না। তাই আমাদের কয়েকজন আর জি. আর স্কুলের কয়েকজন মিলে সালাউদ্দিন স্যারের সাথে কোচিং শুরু করলাম পানামে গিয়ে। কোচিং করলাম ৩ মাস। বাসায় টেস্ট পেপার কিনে অন্যান্য বিষয়ে পরিক্ষা দিতে থাকলাম। এভাবেই আমি বলতে গেলে একা একা পড়েই পরিক্ষা প্রস্তুতি শেষ করলাম।
১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাস। বৈদ্যের বাজার এন,এ,এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে এস এস সি পরিক্ষা দিলাম। থিওরিটিকেল পরিক্ষাগুলো ভালোই হল কিন্তু সমস্যা হল প্রাক্টিকেল পরিক্ষায়। স্কুলে কোনদিন প্রাক্টিকেল কাজ করা হয় নাই। তাই এই নিয়ে আমার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। আবার আমি ছিলাম আমার স্কুল থেকে একা ছাত্র। পরিক্ষার দিন আমার কোন বিজ্ঞানের স্যারও ছিল না। আমার প্রাক্টিকেল পরিক্ষার সময় আমাদের ইংরেজি শিক্ষক সিদ্দিক স্যার যেতেন কারন বিজ্ঞানের যে নতুন শিক্ষক আসছিলো তিনিও পরিক্ষা শুরুর আগে চলে যান। সবকিছু মিলে আমার প্রাক্টিকেল পরিক্ষাগুলো তেমন ভালো হল না।

১৯৯৮ সালের ২শরা অগাস্ট। ফলাফলের দিন। তখন বর্ষাকাল আর এখনকার মত রাস্তাও ছিলো না। নৌকা করে যোগাযোগ হত। সেইদিন আমি, মোক্তার মামা আর আমার চাচাতো মনির ভাই মিলে ফলাফলের জন্য নৌকা নিয়ে উপজেলার উদ্দেশ্যে রওনা হই। কারন তখন উপজেলায় স্কুলের শিক্ষদের হাতে বিকালে ফলাফল দিতো। তারপর তারা স্কুলে এসে ছাত্রদের জানাতো। কিন্তু আমরা তাড়াতাড়ি ফল জানার জন্য উপজেলা চলে যাই। মোক্তার মামা ও মনির ভাই আমার পড়াশোনার সাথি ছিল। আমরা বাড়িতে সবাই মিলে প্রতিযোগিতা করে পড়তাম যদিও মামা ও মনির ভাই ছিল মানবিক শাখায়। ফলাফলের সেইদিন, যখন উপজেলায় পৌছালাম, মোক্তার মামা বলল, পাস করি বা ফেল করি আগে মিস্টি খেয়ে নেই। কথামত সবাই ফলাফলের আগে মিস্টির দোকানে বসে মিস্টি খেয়েছিলাম।
অনেকক্ষন অপেক্ষা করার পর বিকাল ৪টার দিকে ফলাফল আসলো আমাদের প্রধান শিক্ষকের হাতে। স্যার বলতেছেন যে আমি ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছি। স্যারেরা সবাই আমার ফলাফলে খুশি কিন্তু আমি খুশি না। আমার আরো বেশি আশা ছিলো। তাই আমি বার বার ফলাফলের কাগজটা দেখতেছিলাম। হঠাৎ চোখে পরলো আমার ফলাফলের সাথে ছোট একটা তারা(*)। আমি তখন স্যারকে বললাম, স্যার, আমার ফলাফলের সাথে এই তারাটা কি। তখন সবাই ভালো করে দেখে বলল, এইটা স্টার। আরে সাইদুল ত স্টার মার্ক পেয়েছে। আমার জীবনে সেরা মুহূর্তগুলো মাঝে সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত ছিলো এইটা।
আমাদের সনমান্দী স্কুল থেকে এ-যাবৎ সর্বমোট দুটো স্টার মার্ক পায়। একটা সেলিম হায়দার ভাই, উনি ১৯৯৩ সালে মানবিক বিভাগ থেকে আর আমি ১৯৯৮ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। একটু মজা করে বললে, সনমান্দী থেকে আর কেউ স্টার মার্ক পায় না আর ভবিষ্যতে পাবে না। কারণ এখন আর সেই স্টার মার্ক নাই।
“গুপী গাইন বাঘা বাইন” গল্পের দুই নায়ক গুপি ও বাঘার মত আমিও ছোট বেলায় কোনকিছু ভালোভাবে করতে পারতাম না। মা বাবা সহ সবাই বলত আমি একটু কম বুঝি, সোজা কথায় যাকে বলে বোকা। আমার নিজের প্রতি নিজের আত্নবিশ্বাসও কম ছিলো। তাই বার বার এই বইটি পড়তাম আর ভাবতাম, গুপি আর বাঘার মত আমিও যদি কোন ভূতের দেওয়া বর পেতাম যা দিয়ে জীবনের আত্নবিশ্বাস বাড়াতে পারতাম।
নব্বই দশকে মফস্বল এলাকায় সনমান্দী হাসান খান উচ্চ বিদ্যালয়ের মত একটি বিদ্যালয় থেকে যতই না পাওয়া থাকুক না কেন, আমি এই স্কুল থেকে আত্নবিশ্বাসের একটা বর পেয়েছি। এই সনমান্দী স্কুল থেকেই আমার লেখাপড়ার বুঝ শুরু হয়। আমার সপ্ন দেখার শুরুটাও এই সনমান্দী হাসান খান উচ্চ বিদ্যালয় থেকেই। আজ যেখানেই থাকি, যত পড়াশোনা বা যত ভালো অবস্থায় কাজই করি না কেন, সনমান্দী স্কুলই আমার জীবনে সবকিছুর প্রথম অধ্যায়।